
আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
দীর্ঘ দুই বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর অবশেষে গাজায় শান্তির সূচনা হয়েছে। যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে বন্দিবিনিময় সম্পন্ন হয়েছে। সোমবার হামাস জীবিত জিম্মিদের ইসরায়েলের হাতে তুলে দেয় এবং মৃত জিম্মিদের মরদেহ ফেরত দেওয়া শুরু করে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ইসরায়েলও তাদের কারাগারে আটক ১ হাজার ৯৬৮ জন ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দিয়েছে।
ইসরায়েলের কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, ওফের ও কেতজিওত কারাগার থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দীদের পশ্চিম তীরের রামাল্লা, পূর্ব জেরুজালেম ও কেরেম সালোম এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। মুক্ত ফিলিস্তিনিদের স্বাগত জানাতে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। খান ইউনিসে নাসের হাসপাতালের বাইরে উচ্ছ্বসিত জনতা পতাকা ও ব্যানার হাতে বন্দীদের বরণ করে নেয়।
গাজার দক্ষিণাঞ্চলের ইয়াসির আবু আজুম বলেন, “২০২৩ সালে আমার ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। দুই বছর পর তাকে আবার দেখলাম। আমি এত খুশি যে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।”
🔥 দুই বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। এতে প্রায় ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হন এবং ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। এর প্রতিশোধে গাজা উপত্যকায় ভয়াবহ হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী, যাতে গত দুই বছরে নিহত হন ৬৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি।
এই সময়ের মধ্যে ধাপে ধাপে বেশিরভাগ জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছিল হামাস। সর্বশেষ রেডক্রসের মাধ্যমে ২০ জন জীবিত জিম্মিকে ফেরত দেওয়া হয়। বাকিদের মধ্যে ২৮ জন নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে হামাস।
🇺🇸 ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর ও ‘শান্তি সম্মেলন ২০২৫’
বন্দিবিনিময়ের দিনই মধ্যপ্রাচ্যে সফরে যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটে ভাষণ দেন তিনি। ভাষণ চলাকালে ‘জেনোসাইড’ লেখা কাগজ উঁচিয়ে প্রতিবাদ জানান আইনপ্রণেতা আয়মান ওদেহ। এতে পার্লামেন্টে হট্টগোল সৃষ্টি হয় এবং ট্রাম্পের বক্তব্য কিছু সময়ের জন্য বন্ধ থাকে।
পরে ট্রাম্প মিসরের শারম আল–শেখে আয়োজিত ‘শান্তি সম্মেলন ২০২৫’-এ যোগ দেন। তাঁর প্রস্তাবিত ২০ দফা ‘শান্তি পরিকল্পনা’র ভিত্তিতে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হয়। সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, তুরস্ক, কাতারসহ ২৮ দেশের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল–সিসি, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ, জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ মের্ৎস এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার সম্মেলনে উপস্থিত থেকে যুদ্ধবিরতির নথিতে স্বাক্ষর করেন।
ট্রাম্প বলেন,
“বছরের পর বছর ধরে চলা দুর্ভোগ ও রক্তপাতের পর অবশেষে গাজায় ফিরেছে শান্তি। আকাশ এখন শান্ত, বন্দুক নীরব, এবং এই ভূমিতে সূর্য উঠেছে নতুন আশার প্রতীক হয়ে।”
⚖️ বন্দী নির্যাতনের অভিযোগ
তবে ফিলিস্তিনি মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইসরায়েলি কারাগারে বন্দীদের ওপর অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছে। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত সাংবাদিক আলা–রিমায়ি আল–জাজিরাকে বলেন, বন্দীদশায় তাঁকে অনাহারে রাখা হয়েছিল, এবং তাঁর ওজন ৫০ কেজি কমে যায়।
তিনি বলেন,
“মুক্তি পেয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলে সে বলল, ‘বাবা, তুমি আমাকে ব্যথা দিচ্ছ।’ তখন বুঝলাম, অনাহারে আমার শরীর শুধু হাড়ে পরিণত হয়েছে।”
বিশ্লেষক বাসিল ফারাজ বলেন, বন্দিবিনিময় হলেও নির্যাতনের সংস্কৃতি বন্ধ হবে না যতক্ষণ না দখলদারি শেষ হয়।
🌍 বিশ্বের প্রতিক্রিয়া
বিশ্বনেতারা গাজা যুদ্ধবিরতিকে “ঐতিহাসিক টার্নিং পয়েন্ট” হিসেবে দেখছেন। মার্কিন প্রশাসন এই উদ্যোগকে মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেছে।
মিসরের প্রেসিডেন্ট সিসি বলেন, “আজকের শান্তি সম্মেলন মানবতার জয়।”